সিংগ্যাল পড়লে চিন্তা বাড়ে

30/04/2011 00:26

রফিকুল ইসলাম, কুতুবদিয়া থেকে | তারিখ: ২৯-০৪-২০১১

প্রথম আলো>>

সিংগ্যাল পড়লে চিন্তা বাড়েআঁর যে চাইরগুয়া পুয়ামাইয়া আছে, আঁই ইতারারে ক্যান গইরগমআজিয়ের দিনে তুয়ানের সময় আঁই বাপ-মা ভাই-বইন সব হারাই ফালাইছিআল্লার হাচে চাই আঁর মত এতিম যেন কেওরে নঁ গরে
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে সব হারানো তাহমিনা আকতার এভাবেই জানালেন তাঁর এক বদ্ধমূল আতঙ্কের কথাকুতুবদিয়ার কৈয়ার বিল ইউনিয়নের রোশাইপাড়া গ্রামে বাড়ি তাঁরঘূর্ণিঝড়ে বাবা-মা ও পাঁচ ভাই-বোনকে হারিয়েছেন তাহমিনাতাঁদের লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি২০ বছর আগের সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও তাড়িয়ে ফেরে তাহমিনাকেঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ সংকেত দেওয়া হলেই বাড়ে আতঙ্কতাঁর চিন্তা এখন নিজের চারটি সন্তান নিয়ে
সেই ভয়াল রাতের কথা মনে করতে গিয়ে চোখ ভিজে ওঠে তাহমিনারসেদিন দুপুরের পর থেকে বাড়ছিল বাতাসের ঝাপটারাত নামতে না-নামতেই বাড়তে থাকে পানিঘরে পানি উঠে গেলে আশ্রয় নেন চালের ওপরএকপর্যায়ে পরিবারের সবাইকে ভাসিয়ে নেয় ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট ভয়াবহ পানির তোড়কিছু সময় বাবা জালাল আহমেদের হাত আঁকড়ে ছিলেনতাঁকেও বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেননিশেষ পর্যন্ত শোকের বোঝা বইতে বেঁচে থাকেন তাহমিনা একা
৯১-এর পর গত ২০ বছরে আরও বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় আতঙ্কের মুখে ফেলে দিয়েছিল কুতুবদিয়াবাসীকেসংকেত দেওয়া হলেই এলাকায় শুরু হয় ছোটাছুটিগত কয়েক বছরে ঘূর্ণিঝড় ছাড়াও এলাকায় বেড়েছে সুনামি-আতঙ্ক
দেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে তিন দিকে বঙ্গোপসাগর ও এক দিকে ভয়াল কুতুবদিয়া চ্যানেলবেষ্টিত এ উপজেলায় ৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটেবহু মানুষ নিখোঁজ হয়জলবেষ্টিত কুতুবদিয়া পরিণত হয় বিরানভূমিতেএত দিনেও এক লাখ ২০ হাজার জনসংখ্যার এই ভূখণ্ডটিকে নিরাপদ করা যায়নি
বড়ঘোপ ইউনিয়নের বিদ্যুবাজারে কথা হয় আমজাখালি গ্রামের জয়নাল আবেদিন, শাহাদাত হোসেন, নূর মোহাম্মদ, জাভেদ আহমেদসহ অনেকের সঙ্গেতাঁরা জানান, ’৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর গত ২০ বছরেও এখানকার মানুষের আতঙ্ক কাটেনি৪ নম্বর সংকেত থেকে এই জনপদে আতঙ্ক শুরু হয়৭ নম্বর সংকেত হলে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে থাকেন তাঁরাঘূর্ণিঝড়ের সংকেত দেওয়া হলে এখানকার মানুষের কাজকর্ম মাথায় ওঠেপ্রয়োজনের তুলনায় কম আশ্রয়কেন্দ্র ও বেড়িবাঁধের অভাব আতঙ্কের অন্যতম কারণ
কুতুবদিয়া ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি সূত্র জানায়, ’৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের পরই মূলত কুতুবদিয়ায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ শুরু হয়তবে উপজেলায় এখন ৭৩টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অধিকাংশই ব্যবহারের অনুপযোগীএলজিইডির আওতায় সরু পিলারের ওপর নির্মিত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে যেতে ভয় পায় এলাকার মানুষদুর্যোগের সময় আশ্রয়ের জন্য উপজেলায় রয়েছে ছয়টি কিল্লা
রেড ক্রিসেন্টের চারটি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে তিনটিই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছেঅভিযোগ রয়েছে, সব আশ্রয়কেন্দ্র এলাকা ও লোকসংখ্যা বিবেচনায় নির্মাণ করা হয়নি
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, কুতুবদিয়ার ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের পাঁচ কিলোমিটার বিভিন্ন সময়ে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে১৭ কিলোমিটার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ও ১৮ কিলোমিটার রয়েছে ঝুঁকির মুখে৯১-এর পর ৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল বেড়িবাঁধ নির্মাণেএরপর সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে বিভিন্ন সময় বরাদ্দ হয়েছে আরও ১৫০ কোটি টাকা
স্থানীয় লোকজন বলছেন, বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও কুতুবদিয়া জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকির মুখেই থাকছেবাঁধ না থাকায় তাবলার চর, বায়ুবিদ্যু পাইলট প্রকল্প এলাকা, হাইদরবাপেরপাড়া, কাহারপাড়া, জেলেপাড়া, উত্তর ধুরং কাইছারপাড়া ও চর ধুরং এলাকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছেবাঁধের অভাবে কুতুবদিয়া ধীরে ধীরে সাগরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বলেও অনেক দিন ধরেই উদ্বেগ রয়েছে বাসিন্দাদের
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির উপজেলা টিম লিডার গোলাম রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর এখানকার মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে সংকেতব্যবস্থার ক্ষেত্রে তারা খুবই সজাগতবে সমস্যা রয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রের ক্ষেত্রেপ্রয়োজনের তুলনায় এখানে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা অনেক কমআবার এর অধিকাংশই ব্যবহারের অনুপযোগীঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির উপজেলা কর্মকর্তাসহ কয়েকটি পদ খালি রয়েছেপ্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে যানবাহন ও উপকরণেরও অভাব রয়েছে
একই ধরনের কথা বললেন কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নূরুল বশর চৌধুরীওপ্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘১৯৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর এখানে প্রস্তুতিমূলক অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়ওই ঘূর্ণিঝড়ে অনেক লোক মারা যাওয়ার একমাত্র কারণ ছিল আশ্রয়কেন্দ্রের অভাবএরপর বেশ কিছু আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হলেও তা পর্যাপ্ত নয়বহু আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছেআশ্রয়কেন্দ্র ও রাস্তাঘাট বাড়াতে হবে
কক্সবাজার-২ আসনের সাংসদ হামিদুর রহমান আযাদ অভিযোগের আঙুল তুললেন সরকারের দিকেপ্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় কুতুবদিয়ায় কোনো ধরনের প্রস্তুতি নেইসংকেত পেলে এখানকার মানুষ আতঙ্কিত হয়তবে সরকার এ বিষয়ে মোটেই আতঙ্কিত নয়নিরাপত্তার অভাবে সংকেত পাওয়ার পরও মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যায় না
বাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্র প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম মন্তব্য করে সাংসদ আযাদ বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা পাওয়া তো দূরের কথা, দ্বীপ কুতুবদিয়ার অস্তিত্ব রক্ষা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে

Source: Prothom Alo

Back
Site Fights Spirit Counter

The Site Is Designed & Sponsored By Kamrul Islam Mishu Kutubi